FACULTY (Music Department)
Name | Designation | Qualification | Specialisation | |
Prof. Amrita Majumdar | Assistant Professor, Head of the Department | M.Mus.NET, Ph.D. (pursuing, Visva-Bharati) | Hindusthani Classical Music (Vocal) | |
Dr Subarna Mukherjee | State Aided College Teacher |
M.Mus, Ph.D. |
Hindusthani Classical Music (Vocal) | |
State Aided College Teacher |
M.A , NET | Rabindrasangeet | ||
Ms. Sneha Das |
State Aided College Teacher | M.A. | Vocal Music (Bengali Song) | |
Sri Sabitabrata Pal |
State Aided College Teacher | M.A. | Rabindrasangeet | |
Ms. Koushambi Mukhopadhyay | State Aided College Teacher | M.Mus. | Hindusthani Classical Music (Vocal) |
Department Activity:-
Course Outcome, Programme Outcome and Programme Specific Outcome(UG) of the Year 2015-16
Course Outcome, Programme Outcome and Programme Specific Outcome(UG) of the Year 2016-17
Course Outcome, Programme Outcome and Programme Specific Outcome(UG) of the Year 2017-18
Course Outcome, Programme Outcome and Programme Specific Outcome(UG) of the Year 2018-19
Syllabus Module of Department of Music(PG)
SYLLABUS MODULE OF DEPARTMENT OF MUSIC(PG)
SYLLABUS MODULE OF DEPARTMENT OF MUSIC(UG)
Click Here To Download the Departmental Routine:-
Innaguration of Wall Magazine
Department of Music
World Music Day, 2019
Organised by
Department of Music
Student Seminar
Student Seminar 2018-19
Organized by Department of Music
on
'সঙ্গীত মননে রবি ভাবনা'
PROJECT WORK ON "বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শেষ জীবনের রচনা"
জীবনের শেষ দশকে (১৯৩২-৪১) রবীন্দ্রনাথের মোট পঞ্চাশটি গ্রন্থ প্রকাশিত হয়। তাঁর এই সময়কার কাব্যগ্রন্থগুলির মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ‘পুনশ্চ’ (১৯৩২), ‘শেষ সপ্তক’ (১৯৩৫), ‘শ্যামলী পত্রপুট’ (১৯৩৬)- তিনটি গদ্য কবিতা সংকলন। জীবনের এই পর্বে সাহিত্যের নানা শাখায় পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছেন। তাঁর ফলে পরবর্তীকালে আমরা পেয়েছি একাধিক গদ্যগীতিকা ও নৃত্যনাট্য ‘নটীর পূজা’(১৯৩২), ‘তাসের দেশ’ (১৯৩৩), ‘চিত্রাঙ্গদা’ (1936), শ্যামা (১৯৩৯), ‘চণ্ডালিকা’(১৯৩৯) নৃত্যনাট্যত্রয়ী। এছাড়া রবীন্দ্রনাথ তাঁর শেষ তিনটি উপন্যাস ‘দুইবোন’ (১৯৩৩), ‘মালঞ্চ’ (১৯৩৮), ও ‘চার অধ্যায়’ (১৯৩৮) এই পর্বেই রচনা করেন। তাঁর অধিকাংশ ছবি এই সময়ে আঁকা। এর সঙ্গে সঙ্গে জীবনের শেষ বছরগুলিতে বিজ্ঞান বিষয়ে আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন। ১৯৩৭ এ প্রকাশিত হয় তার বিজ্ঞান বিষয়ক প্রবন্ধ সংকলন ‘বিশ্বপরিচয়’। জীবনের এই পর্বে ধর্মীয় গোঁড়ামি ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন।
জীবনের শেষ চার বছর ছিল তাঁর ধারাবহিক শারীরিক অসুস্থতার সময়। এই সময়ের মধ্যে দুইবার অত্যন্ত অসুস্থ অবস্থায় শয্যাশায়ী থাকতে হয়েছিল তাঁকে। ১৯৩৭ সালে একবার অচৈতন্য হয়ে আশঙ্কাজনক অবস্থা হয়েছিল। সেবায় সেরে উঠলেও ১৯৪০ সালে অসুস্থতার পর আর সেরে উঠতে পারেনি। এই সময়ে রচিত রবীন্দ্রনাথের কবিতাগুলিতে ছিল মৃত্যুচেতনাকে কেন্দ্র করে অবিস্মরণীয় কিছু পংতিমালা। মৃত্যুর সাতদিন আগে পর্যন্ত কবি সৃষ্টি করে গেছেন।
রবীন্দ্র শেষজীবনের কাব্যপ্রবাহ:
রবীন্দ্রনাথের কাব্য বহুবর্ণময়। তাঁর কাব্য কখনও রক্ষণশীল দ্রুপদী শৈলীতে, কখনও হাস্যোজ্জ্বলে, বা আনন্দ উল্লাসে, কখনও বা দার্শনিক গাম্ভীরে মুখরিত। সাধারণত রবীন্দ্রনাথের কাব্যে প্রভাব বিস্তার করেন উপনিষদ রচয়িতা ঋষিকারিগণ। এদেঁর মধ্যে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য হলেন ব্যাস। ১৯৩০ এর দশকে একাধিক পরীক্ষামূলক রচনায় তিনি বাংলা সাহিত্যে সদ্য আগত আধুনিকতা ও বাস্তবতাকে স্বাগত জানিয়েছিলেন।
এই নতুন রীতির পরিবর্তনে কিছু আকস্মিক খেয়াল বশে না তা ‘বলাকা’ বা তার সমসাময়িক রচনাতেই স্পষ্ট। তবে বিষয়বস্তু নির্বাচনের অভিনভত্ব ‘পুনশ্চ’ থেকেই দৃষ্টিগোচর। তার মধ্যেই ঋতু পরিবর্তন প্রথম প্রমাণ।
পুনশ্চ:(১৯৩২) জীবনের শুরুতে রবীন্দ্রনাথ ঘরের মধ্য দিয়ে জানালার ফাঁক গলিয়ে বিশ্ব-প্রকৃতিকে দেখতেন ঠিক সেই রকমই ‘পুনশ্চ’ কাব্যগ্রন্থের মধ্যে আত্মভোলা শিশুও যে প্রকৃতির মায়ায় ঘর থেকে বের হয়ে এসে আর গৃহে ফিরতে চায় না। তার এই মনের গভীর ভাবকে কবি সুন্দর ভাবে উপস্থাপন করেন। শিশুমনের জগতকে তিনি যে মানসচক্ষু দিয়ে দেখতেন তার প্রমণ পাওয়া যায় ‘ছেলেটা’, ‘বালক’, ‘অপরাধী’ কবিতাগুলির মধ্য দিয়ে। রবির নিজস্বতা হল বাংলার জনপদ মানুষ আর প্রকৃতির বিশাল সাম্রাজ্যকে প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করেছেন। ‘পুনশ্চ’ কাব্যগ্রন্থের মধ্যে ছন্দবদ্ধ কবিতা আছে বেশ কয়েকটি। ‘কোমলগান্ধার’, ‘ছুটি’, ‘ঘরছাড়া’, ‘অস্থানে’, প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। একই কাব্যে ক্রমাগত ভাব পরিবর্তন আমাদের চিন্তাজগতকে অগ্রসর করে তোলে রবি নিবিড় ভাবে পাঠ করলে। ‘পুনশ্চ’ কাব্যগ্রন্থ সম্পর্কে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, “ পুনশ্চ কাব্যগ্রন্থে অধিভৌতিককে সমাদর করে ভোজে বসানো হয়েছে।” আবার কখনও তিনি উচ্চারণ করেন, আমার বক্তব্য ছিল এই কাব্যকে বেড়াভাঙা গদ্যের ক্ষেত্রে স্ত্রী স্বাধীনতা দেওয়া যায় যদি তা হলে সাহিত্য সংস্কারের আলংকারিক অংশটা হাল্কা হয়ে তার বৈচিত্রের দিক, তার চরিত্রের দিক, অনেকটা খোলা যায়গা পায় কাব্য জোরে পা ফেলে চলতে পারে।”
শেষ সপ্তক(১৯৩৫) গর্জন ও গাত্র, তাণ্ডব ও তরল, অগ্নিনিঃশ্বাস ও জলপ্রপাত, শ্যামল কোঠরে মেশানো এই নতুন কাব্যরুপ- বিশেষভাবে ফুটে উঠেছে ‘শেষ সপ্তক’ এর সার্থক ও গভীর ভাব ব্যঞ্জক কবিতাগুলিতে। ‘শেষ সপ্তক’এর ১, ২, ৩, ১৪, ৩২ নং কবিতা গুলিকে নিছক প্রেমের কবিতা বলাই যায়। কিন্তু কবিতাগুলিতে হৃদয়াবেগের প্রাধান্য নেই, কল্পনার উদ্দীপনা কিংবা পঞ্চম রাগের আতিশয্য নেই। দেহচিত্তের উদগ্র কামনার দীপ্তি রবীন্দনাথের প্রেমের কবিতায় এমনি অনুপস্থিত। ‘শেষ সপ্তক’ এর অনেকগুলি কবিতাই কবির ব্যক্তিজীবনের নিবিড় ও নিগূড় পরিচয়ের অলোকে উদ্ভাসিত।
পত্রপুট:(১৯৩৬) ‘পত্রপূট’এর কবিতাগুলি জীবনের অনুভূতির কথা তত বলে না; অসংখ্য ও বিচিত্র অনুভূতির পশ্চাতে সৃষ্টির যে গভীর নিয়তি নিয়ম সক্রিয় যে গহন গভীর চিন্তা অপূর্ব বর্ণচ্ছটায় বিচ্ছরিত সেই সব চিন্তা ও রহস্যের কথাই প্রবলভাবে ফুটে উঠেছে। ‘পত্রপূট’-এ জীবন ও সৃষ্টির মূল সূত্রগুলি মনন ও কল্পনায় গভীরে প্রসারিত হয়। কবিতাগুলিকে এই সমস্ত উপাদান অভিনভত্ব দান করেছে। এই অন্তর্নিহিত ধ্বনিছন্দই গদ্য কবিতার রীতিতে এপিক রচনা করেছেন। নিছক গদ্যই এর গভীর তরঙ্গ প্রবাহ, গম্ভীর ধ্বনিমোহ সৃষ্টি সম্ভব। গদ্যছন্দের যে গভীর মানস কল্পনা রুপায়িত করা যায় ‘পত্রপুট’ তার দৃষ্টান্ত।
বীথিকা: (১৯৩৪-৩৫) ‘বীথিকা’র কবিমানস অতি গভীরে প্রসারিত। গভীর গম্ভীর জীবন জিজ্ঞাসায় রুপান্তরিত। অতীথ ও বর্তমান, নিসর্গ ও বিশ্বজীবন বা এক কথায় বিশ্বসত্তা, প্রেম ও অনুরাগ, জীবন ও মৃত্যু। ব্যক্তিগত জীবনের ছায়া ও স্বপ্ন, মনন ও কল্পনা সব কিছু জড়িয়ে বিদীর্ণ করে এই আত্মলীন জীবন জিজ্ঞাসাই এর বিষয়বস্ত। এর সুগভীর পরিব্যপ্তি, শান্ত নিস্তব্দ অনুভব ও জীবনের পুরানো মূল দর্শনই এর আদর্শ। এই ভাব ও বস্তুর পরিবেশে রোম্যান্টিক দৃষ্টিভঙ্গি প্রসূত। সন্দেহ নাই এই দৃষ্টি একেবারে সৃষ্টির শুরু ও প্রলয়ের মূল পর্যন্ত বিস্তৃত। এর কিছুই কবির দর্শন ও মন থেকে বাদ যায় না। গভীর চিত্ত ও কল্পনা সমৃদ্ধিতে কবিতাগুলি সমৃদ্ধ। ‘বীথিকা’য় প্রেমের কবিতা আছে, সেগুলি প্রায়ই পুরাতন স্মৃতিবহন, কয়েকটি আখ্যানবাহী নীলাচপল কবিতাও আছে। মাঝখানে দু-একটি কবিতায় এবং শেষের দিকে কয়েকটি কবিতায় একটি নতুন সুর শোনা যায়- সে সুর ভাঙনের, বিদ্রোহের, নূতন সৃষ্টির, বন্ধন হতে কলুষ হতে মুক্তির সুর, সংগ্রামের সুর।
প্রহাসীনী:(১৯৩৯) যে গভীর গাম্ভীর্যে নিজের মনে বাসা বেঁধেছিল, নূতন কালের সঙ্গ নিজেরল প্রাণের সুর মিলে যে সব প্রশ্ন, সমস্যা, জট পেকে উঠেছিল, নিজের চোখের সামনে ও মনের মধ্যে যে রুপ গড়ে উঠেছিল সে নতুন জীবন ও মৃত্যুচেতনা চিত্তকে গভীরে টেনে নিয়েছিল ‘প্রহাসিনী’। সেই সমস্ত কিছুর খুঁটি টেনে নাড়িয়ে ক্ষণিক কৌতুকের ছেলেখেলায় মেতে ওঠা। ‘প্রহাসিনী’ একেবারে অন্য জাতের অন্য সুরের কবিতা। হাস্যে-পরিহাসে, প্রলাপে-কৌতুকে, বাদ-কটাক্ষে কবিতাগুলি যেন একে অপরকে জাপটে সৃষ্টি হয়েছে। তবুও বিষয় ভাবনাবিচিত্র-কবির ঠাট্টা কখনও আধুনিক নারী ও তাদের চালচলন নিয়ে, কখনও ভোজন ও তার বিপত্তি নিয়ে, কখনও নিজেকে নিয়ে, কখনও বা আধুনিক কবিতার ভাষা ও দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে। কিন্তু যত কৌতুকই করুক না কেন সবার পিছনে কবির স্পপ্নের গভীর কথাও উঁকি দিয়েছে।
নবজাতক:(১৯৪০) “আমার কারও ঋতু পরিবর্তন ঘটেছে বারে বারে। প্রায়ই সেটা ঘটে নিজের অলক্ষ্যে। ‘নবজাতক’ কাব্যে এই যে হাওয়া বদল থেকে সৃষ্টি বদল এ তো স্বাভাবিক। এমনি স্বাভাবিক যে এর কাজ হতে থাকে অন্যমনে। কবির এ সম্বন্ধে খেয়াল থাকে না।”
জীবনের শেষ অধ্যায়ে যে ঋতু পরিবর্তন আরম্ভ হয়েছিল ‘নবজাতক’ নাম থেকে সে নতুন ঋতুকে চিহ্নিত করলেন-সেই ঋতুর লক্ষণ হলো নতুন সমাজ চেতনা, বৃহৎ জন মানস সম্বন্ধে চেতনা, ইতিহাস চেতনা। এই চেতনার সাহায্যে কাব্যে বস্তুর বাস্তব অনুভূতির সঞ্চার হয়। এই পর্বের কবিতাগুলি নিরালাঙ্কার, বিরলসৌষ্ঠব, স্বল্পভাষিতা। কবির আশ্রয় একান্তভাবে বর্তমান যুগের রেলগাড়ি, এরোপ্লেন, রেডিও প্রভৃতি দ্রব্যের সার্থক উপমায়।
শ্যামলী: (১৯৩৬) এতদিন তিনি যাহাদের গান গেয়েছেন, যে রীতি ও ভাষায় গান ও কবিতা রচনা করেছেন, তা জনগণের মুখের ভাষা নয়; অথচ নতুন কাল তো তাদেরও। তাই যদি তাদের কথাই বলতে হয় তবে তা তাদের মুখের ভাষা ও কথার রীতিতে। এই কাব্যগ্রন্থে যে রীতির পরিবর্তন ঘটেছে একথা স্পষ্ট। ‘শ্যামলী’র পর কবি আর এই নতুন রীতিতে কাব্য রচনা করেননি। ‘শ্যামলী’র দ্বৈত কবিতাই ভাবসৌন্দর্যে অনুভূতির সূক্ষ্মতায় কল্পনার সহজ রহস্য ব্যঞ্জনায় আর গভীর প্রেমে অনবদ্য। কাব্যগ্রন্থের ৪৪ নম্বর কবিতাটি স্নিগ্ধ নিসর্গ-সৌন্দর্যে এবং কবির জীবন সায়াহ্নের শ্যামল কামনায় সুন্দর ও মেদুর। কবি স্থির করেছিলেন তাঁর শেষবেলার ঘরখানি মাটি দিয়ে তৈরি হবে এবং তার নাম হবে শ্যামলী-আর কবিতাটি এই ঘরকে উদ্দেশ্য করে লেখা। ‘শ্যামলী’র কবিতাগুলি লিরিক জাতীয় এবং সেগুলিতে মানব জীবনের ছোট ছোট ছবি, জীবনের ছিন্নপত্র বিস্মৃতির হাওয়ায় উড়তে উড়তে কবির কল্পনায় বাঁধা পড়ে গেছে।
সানাই:(১৯৪০) গীতিকাব্য হিসাবে যে শুধু ‘নবজাতক’ অপেক্ষা ‘সানাই’ মধুরতর তা নয়; এই পর্বের সমস্ত কাব্যের মধ্যে বোধ হয় ‘সানাই’ শ্রেষ্ঠ। শ্রেষ্ঠ সুরের গীতিময়তায়, ভাবমাধুর্যে ও কল্পনাময়, পুরাতন মধুর প্রেমে নতুন আস্বাদনে। অধিকাংশ কবিতাই সেই সুদূর ও কীর্তনী লীলাসঙ্গিনীর স্মৃতির আবেশে আবিস্ট, কৈশোর যৌবনের প্রেম ও সম্ভোগ স্মৃতির নির্যাসে সুরভিত। তবু কবির সমস্ত কল্পনায় যে নতুন দিনের স্পর্শ লেগেছে, নতুন চেতনায় যে কবিচিত্ত উদ্ধৃত হয়েছে- তার সুর ও তাল অন্য জগতের। সূর্যাস্তের পর থেকে বিকালের রোদ নেমে গেছে, বাতাস ঝিমিয়ে গেছে,- এই রবীন্দ্রনাথ নতুন রবীন্দ্রনাথ, শেষ অধ্যায়ের রবীন্দ্রনাথ। কিন্তু কবির সমগ্র জীবনের সাধনা সুরের ছন্দের তালের, ও ঐক্য ও সংহতির, পূর্ণতার ও সমগ্রতার-এটাই রবীন্দ্রনাথের ভাব কল্পনার প্রকৃতি এবং ‘সানাই’ গ্রন্থে তিনি একবার তাঁর নিজের জাত চিনিয়ে গেলেন।
নাটকে শেষজীবনের অবদান
রবীন্দ্রনাথ আধুনিক জীবনের সংশয় দ্বন্দ্বের পরে পরে ভারতীয় সভ্যতার বৈশিষ্ট্য মূল্যবোধ তথা আধ্যাত্মবিশ্বাসের সার্থক রূপায়ণ ঘটিয়েছেন তাঁর নাটকে। নাটকের শৈলী ও বিষয়বস্তু নিয়ে তিনি সারা জীবনই এই পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়ে গেছেন। বিদেশি নাটকের প্রভাব থাকলেও তাঁর নাটক তাঁর ভাঙা গানের মতোই স্বকীয়তারর ভাস্বর। সমকালীন দর্শক সমাজের স্থূলরুচি এই দুর্জ্ঞেয় নাট্য আদিককে সম্যক অনুধাবনে ও গ্রহণে অপরাগ ছিল। ঠিক সেইরকমই বাঙালির নৃত্যকে বিশ্ববাসীর কাছে উপস্থাপন করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। রবীন্দ্র গীতিনাট্যের প্রধান বৈশিষ্ট্য গীতিপ্রাণতা। নাটকের সংলাপগুলি সবই গানে বাঁধা। জীবন প্রভাতের গীতিনাট্যের মাধ্যমে সেই যে বীজ রবীন্দ্রনাথ রোপণ করেছিলেন তার পরিপক্ক ফসল জীবন সায়াহ্নের নৃত্যনাট্য।
নবীন:(১৯৩১) অত্যন্ত সুক্ষ্ম ও গভীর রসসংবেদন, অত্যন্ত গূড় ও ব্যাপ্ত ব্যঞ্জনা, অনুভূতির বিশুদ্ধতায়, ভাবের গভীরতায়, উপলব্ধির সুক্ষ্ম সজীবতায় এবং আনন্দের সর্বব্যাপী উল্লাসে গীতিকবিতার রস সঞ্চারকেও ছাপিয়ে যায় এই নাটকের আবেদন। নৃত্যে-গীতে-আবৃতিতে এদের অভিনয় এমন একটি অপূর্ব আনন্দলোক সৃষ্টি করে যেখানে বিবেক-বুদ্ধি স্তব্দ হয়ে যায়। গান ও নাচের মালা দিয়ে গঠিত ‘নবীন’। গদ্য ব্যাখ্যার সাহায্যে গানগুলিকে গাঁথা হয়েছে। অন্তিম বর্ষা ও বসন্ত এি দুই ঋতুর সৌন্দর্য বর্ণনাই হল ‘নবীন’ এর রসসমগ্রতা।
কালের যাত্রা:(১৯৩২) ‘রথের রাশি’ ও ‘কবির দীক্ষা’ দুটি নাটিকার সমন্বয় কালের যাত্রা। রূপক ধর্মী এই নাটিকার ভাববস্তু গনসচেতন ভারতীয় মানসের ম্যানিফেস্টো। ভারতবর্ষের মহাকালের রথ অচল, ভারতীয় সমাজ ব্যবস্থা ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেছে। পুরোহিততন্ত্র, রাজতন্ত্র, গণতন্ত্রের কাছে সমাজ রথ অচল। পুরোহিতের মন্ত্র, ধনপতির ধনবল কিছুই আর সে রথ চালাতে পারছে না। এমন সময় হৈ হৈ করে এসে পড়ে অগণিত শূদ্রকের দল, যারা এতদিন ওই রথের চাকায় পিষ্ট হয়ে এসেছে শূদ্রের শক্তি বলে চলতে শুরু করলো-জয় হলো শূদ্রদের।
‘কবির দীক্ষা’কে আবার যথার্থ নাটক বলা কঠিন। কোনো ঘটনা নেই, কোনো গতি নেই, আছে শুধু দুজনের কথাবার্তা। তাদের চারিত্রিক বিবর্তন কিছুই নেই-যা আছে তা শুধু একটু তত্ব, ত্যাগের কাব্যীয় দর্শন। শিবমন্ত্রে উপাসক কবি ভিক্ষার মন্ত্রে, ত্যাগের মন্ত্রে দীক্ষা দিয়ে থাকেন।
বাঁশরী(১৯৩৩) ‘বাঁশরী’র চিত্তদ্বন্দ্ব একটু জটিল। ‘বাঁশরী’র গল্পবস্তু বড় গল্প বা ছোটো উপন্যাসের, যথার্য নাটকের নয়। নগরাশ্রয়ী সামাজিক নাটক হলেও এর সার্থকতা দুর্বল; এর ঘটনা সংস্থাপনে অথবা চরিত্রের বিবর্তনে নাটকীয় ধর্মের উপস্থিতি স্বল্পই। ‘বাঁশরী’ নাটক হিসেবে খুব উল্লেখযোগ্য নয়, কিন্তু এর গল্পবস্তু রবীন্দ্র মানসের একটা দিকে সুস্পষ্ট আলোকপাত করে। রবীন্দ্র মানসে নরনারীর প্রেম ও যৌবন সম্বন্ধগত এক অভিনব প্রত্যয়ের সুস্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়।
নৃত্যনাট্যত্রয়ী: নাট্যজীবনের সায়াহ্নবেলায় রবীন্দ্রনাথ মনোনিবেশ করেন নৃত্যনাট্য রচনায়। এই নাটকগুলিতে নর্তক-নর্তকীর ভূমিকায় প্রধান। নট-নটী সেখানে ব্রাত্য বলিলেই চলে। সঙ্গীত-নৃত্য ও অভিনয়ের যুগলবন্দী-এদের নাট্যগুণ নষ্ট করেনি। তাঁর নৃত্যনাট্যত্রয়ী, ‘চিত্রাঙ্গদা’(১৯৩৬), ‘চণ্ডালিকা’(১৯৩৮), ‘শ্যামা’(১৯৩৯)-নায়িকার জটিল হৃহয়দ্বন্দ্ব ও তত্প্রসূত অপরাধের ভিত্তিভূমিতে দণ্ডায়মান চরিত্রগুলির মনস্তত্ত্ব তথা মানসিক বিকাশের স্তরগুলিকে সুস্পষ্ট ভাবে নির্দেশ করে। এর বিপরীতে নৃত্যনাট্য বর্গভূক্ত ‘তাসের দেশ’(১৯৩৩) আসলে সমকালীন ভারতের প্রেক্ষাপটে একটি রাজনৈতিক রুপক নাটক।
চণ্ডালিকা:(১৯৩৮) রূপকধর্মী নাটকের প্রত্যক্ষ আশ্রয় সমসাময়িক সমাজ মানসে। ‘চণ্ডালিকা’ যার অর্থ চণ্ডাল কন্যা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘প্রকৃতি’ নামের মধ্য দিয়ে নাটকে চণ্ডালিকার অবতারণা ঘটিয়েছেন। একটি নিচু শূদ্রক সম্প্রদায়-এর কন্যা হওয়ার জন্য সবাই তাকে দূঃচ্ছাই করে তাড়িয়ে দেয়। এই কারণে সে ঈশ্বরের কাছে প্রতিবাদ জানায়। ঠিক সেই মুহূর্তে বুদ্ধের অনুগামী তৃষ্ণার্ত আনন্দের আগমন ঘটে। প্রকৃতি জল দিতে অস্বীকার করলে আনন্দ বলে যে তৃষিতকে জল দিলে তৃপ্ত করে, তার হাতের জল পবিত্র।
এই এক গন্ডুস জলে জন্ম জন্মান্তরের কালিমা ধুয়ে গেছে প্রকৃতির অন্তরের। প্রথম দর্শনেই আনন্দের প্রেমপ্রার্থী চণ্ডালিকা; কিন্তু আনন্দের প্রত্যাখ্যানে সে চণ্ডাল মা’য়ের থেকে মন্ত্র ছলনার আশ্রয় নেয়।
শ্যামা:(১৯৩৯) বৌদ্ধ ‘মহাবস্তু’ থেকে গৃহীত এই নাটকের আখ্যান বস্তু। বণিক বজ্রসেনকে চুরির অপরাধ থেকে বাঁচাতে শ্যামা উত্তীয় নাম্রী কিশোর প্রেমিক কে কোটাল এর কাছে প্রেরণ করে। অবশেষে উত্তীয় মারা যায়। এই শুভাশুভের দ্বন্দ্ব রবীন্দ্রনাথ দ্বিধাহীনভাবে দেখিয়েছে; বলেছেন মানুষের উত্তরনের পথ মঙ্গলেই। কিন্তু ‘শ্যামা’ অনেকটা ব্যতিক্রমী। শ্যামার প্রেম তীব্র কামনার উদ্বেল। পাপ-পুণ্যের বজ্রসেনের শরীরী সৌন্দর্যে মোহিত লাস্যময়ী শ্যামা। তাই বজ্পসেনকে বাঁচাতে অনায়াসে বলি দেয় ভালোবাসা উত্তীয়কে।
তাসের দেশ:(১৯৩৩) নাটকটি ব্যঙ্গ বহুল তবু একে ব্যঙ্গনাট্য বলতে ইচ্ছা হয় না। এর মূলে একটা গভীর তত্ত্ব আছে, সেই তত্ত্বকে পাঠক ও দর্শকচিত্তের কাছে প্রকাশ করাই উদ্দেশ্য। নাটকে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ টাই আড়ালে অর্থাৎ কাব্য বস্তু ব্যঙ্গ কিন্তু তার নাট্যরূপই প্রধান। তাসের সংকেতচিত্র এবং অভিনয় যতটা স্পষ্ট, নাটকটি পাঠে ততটা মুগ্ধতা আসেনা। ‘তাসের দেশ’ ব্যঙ্গ ও নাট্যের চেয়ে সংকেতের মূল্যটা বেশি। ‘তাসের দেশ’ আমাদের এই জড় সনাতনপন্থী দেশ; যে দেশের মন অলস-অনড়- নির্জীব-পরিবর্তন-বিমুখ- জীর্ণ নিয়ম শৃঙ্খলে বাঁধা। কাগজের ছুরি, তিরি, ছক্কা, পাঞ্জার তাসের দেশে কোথা থেকে এলো দুই সাহসী-দুরন্ত লক্ষ্মীছাড়া রাজপুত্র ও সওদাগরপুত্র। তারাই নিয়ে এলো নিয়মের অবাধ্যতা, মুক্তির গান, উদ্দাম চঞ্চলতা। ভেঙে গেল তাসের দেশ- কাগজের পাঞ্জা ছক্কা তাছের মানুষ হয়ে উঠলো রক্ত মাংসের মানুষ।
শাপমোচন:(১৯৩১)বৌদ্ধ জাতকের ‘মহাবস্তু-অবদান’ অন্তর্গত ‘Story of Kusa’ বা কুশজাতকের আখ্যান অবলম্বনে এই নাটক রচিত। এই ‘রাজা’ নাটকের কাহিনী অবলম্বনে ‘শাপমোচন’ নৃত্যনাট্য রচনা করেন। এর গানগুলি প্রায়ই আগেই আগের রচিত গীতিনাট্য থেকে সংকলিত। তবে ‘শাপমোচন’ সার্থক অভিনয়রুপ লাভ করতে পারেনি। এর ভাববস্তুর মধ্যে নাটকীয় দ্বন্দ্ব বিবর্তনের সুযোগ কম।
শেষজীবনের উপন্যাস যাপন: রবীন্দ্র উপন্যাস বাংলা ভাষায় তাঁর অন্যতম জনপ্রিয় সাহিত্যকর্ম। ১৯৩২-৪১ সালের মধ্যে রবীন্দ্রনাথ মোট তিনটি উপন্যাস রচনা করেন। তিনটি ভিন্ন আঙ্গিকে রচিত উপন্যাসগুলি।
দুই বোন:(১৯৩৯) গল্পের উজ্জ্বলতম চরিত্র শর্মিলা। রবীন্দ্রনাথ বারবারই বলেছেন সে অসাধারণ, সে পৃথিবীর মানুষ নহে, আমাদের অনেক ওপরে। শর্মিলার অসুস্থতার সুযোগ নিয়ে শশাঙ্ক দুরন্ত প্রেমের উন্মাদনায় আত্মবিস্মৃত। তখনই তার কাজের অবহেলা করিতে থাকে। দুর্বল শশাঙ্কের পৌরুষত্বে আঘাত লাগে। প্রথমে শর্মিলা কিছুটা বিচলিত হলেও পরে বুঝতে পারে উর্মি না থাকলে শশাঙ্কের ব্যবসা আরও কিছুটা অবহেলার সম্মুখিন হবে। পরবর্তীকালে শশাঙ্ক ও উর্মিকে প্রারম্ভিক প্রশয় দিতে শুরু করলো। আমাদের সঙ্গে সঙ্গে প্রশ্ন জাগে শর্মিলা কী সত্যিই এতটাই অসাধারণ। ‘দুই বোনে’ শর্মিলাই একমাত্র চরিত্র যা পাঠককে শেষপর্যন্ত গল্পে ধরে রেখেছিল।
মালঞ্চ:(1934)স্ত্রী’র অসুস্থতার সুযোগে স্বামীর অন্য স্ত্রীলোকের প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ে। এই বিষয় যথা উপজীব্য করেই রবীন্দ্রনাথ ‘মালঞ্চ’ উপন্যাস সৃষ্টি করেন। কিন্তু ‘মালঞ্চ’ Modern Comedy নয়, গভীর ট্র্যাজিক ভাবে স্পর্শ।
চার অধ্যায়(১৯৪১) রবীন্দ্রনাথের শেষ উপন্যাস ‘চার অধ্যায়’ সবচেয়ে বস্তু ঘনিষ্ঠ চরিত্র কানাই এবং বটু আর সবচেয়ে মধুর চরিত্র অখিল। এলার মধ্যে সুপ্তমাতা ও দিদির চিত্তকে টেনে বার করে তাঁর সঙ্গে নাম কিনেছে। ‘চার অধ্যায়’ য়ের সুর গীতিকাব্যের তীব্র লিরিকলের ধ্বনি ও মোহ, উত্তাপ ও আবেগকে।
যখন পত্রসাহিত্যিক রবীন্দ্রনাথ
পৃথিবীতে খ্যাতনামা পত্রলেখক বলে যারা পরিচিত রবীন্দ্রনাথ তাঁদের মধ্যে অন্যতম। সাহিত্যজীবন ও কর্মজীবনের সুদীর্ঘে অধ্যায়ে কবিকে অগণিত মানুষের সংস্পর্শে আসতে হয়েছিল। ফলে যৌবনের প্রারম্ভ থেকে মৃত্যুর কিছুকাল পূর্ব পর্যন্ত তাঁকে অবিরত চিঠিপত্র লিখতে হয়েছিল-কাছের ও দূরের মানুষকে, আত্মীয়কে, দেশে ও বিদেশে, বাংলায় ও ইংরেজিতে। রবীন্দ্রনাথের পত্রের সংখ্যাও যেমন প্রচুর, বৈচিত্রও সেরুপ নানাবিধ। তার পত্রে শিল্পসৌন্দর্যের শ্রেষ্ঠ নিদর্শন যেমন পাওয়া যায় তেমনি তাঁর পত্রের ব্যবহারিক প্রয়োজনীয়তার দিকটিও বেশ উজ্জ্বল। সেইরকমই তাঁর শেষ জীবনের জীবদ্দশায় ফুটে উঠেছে ‘রাশিয়ার চিঠি’ শীর্ষক ভ্রমনকথা।
রাশিয়ার চিঠি(১৯৩১) রবীন্দ্রনাথের ‘রাশিয়ার চিঠি’ এক ভিন্নস্বাদের পত্রাবলী। ড. অসিতকুমার মুখোপাধ্যায় বলেছেন, “রাশিয়ার চিঠি রুশদেশের ভ্রমণকথা। দেশের বিপ্লবোত্তর জীবনের গৌরব ইতিহাস, তাদের রাষ্ট্র, সমাজ ও ঐতিহ্যের সহৃদয় ব্যাখ্যা তাঁর আগে বিশ্বের কোনো কবি সাহিত্যিকই সাহস করেনি। ব্রিটিশ শাসক একদা রাশিয়ার ‘জার’ জুজুর ভয়ে কম্পমান ছিলেন বিপ্লবোত্তর যুগের রাশিয়াকে ঘিরে বলশেভিক নীতি শাসক সম্প্রদায়ের নিদ্রাতন্দ্রা কেড়ে নিয়েছিল। সেই যেুগে কবিগুরু খোলা মনে রুশদেশের গৌরবকথা প্রকাশ করেন। ‘রাশিয়ার চিঠি’-রাশিয়াকে জানার এক মস্ত দলিল।
উপসংহার:কবির মৃত্যুকালে তাঁর বয়স ছিল ৮০ বছর। এই সুন্দর আলোকময় পৃথিবী ছেড়ে মানুষ চলে যায় এক অজানা রহস্যময় জগতে। পৃথিবীলোকে আসা এবং চলে যাওয়ার মাঝখানে রয়েছে এক সীমাহীন সৃষ্টিরুপী সাফল্যের জগত, যা নিজ কর্তৃক আয়ত্ত করে নিতে হয়। আর বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই সময়টুকুতে নিজ সৃষ্টির আধারে সমস্ত জগতের শিল্প সাহিত্যের ভান্ডারকে নিজ আয়ত্তে নিয়ে এসে সাফল্যের সর্বোচ্চ শিখরে পৌঁছে দিয়েছেন এবং সাথে সাথে নিজ নাম পৃথিবীর বুকে স্বর্ণাক্ষরে লিখে গেছেন।
বিশ্বের কবি তুমি
সাহিত্য সাগরে
পৃথিবী বক্ষে লেখা
খোদিত স্বর্ণাক্ষরে।।
Innaguration of Wall Magazine named " Banglar Loksangeet: Oitijhya O sanskriti" by Department of Music